শব্দহীন লড়াই! দারিদ্র্য, নিঃসঙ্গতা, প্রতিবন্ধকতা—সব ছাপিয়ে মাধ্যমিকের পরীক্ষার টেবিলে পুজা!
পিন্টু কুন্ডু, বালুরঘাট, ১৩ ফেব্রুয়ারী —— পরীক্ষার হলে পা রাখতেই একঝলক তাকিয়ে দেখে চারপাশ। কেউ শেষ মুহূর্তের নোট ঝালিয়ে নিচ্ছে, কেউ একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু পুজা সিং নিঃশব্দ। না, সে চুপ নয়—সে তো কখনোই কথা বলতে পারেনি! চারপাশের চেঁচামেচি, শিক্ষক-পরীক্ষকের নির্দেশ, সাইকেলের ঘন্টা—এসবের কোনওটাই তার কানে পৌঁছায় না। তবু সে এসছে! মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য, নিজের ভাগ্যকে নিজেই নতুন করে লেখার জন্য!
দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের ভাটপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বৈদ্যনাথ পাড়ার ১৬ বছরের এই মেয়েটির জীবনের গল্প কোনও সিনেমার চেয়েও নাটকীয়। জন্ম থেকেই সে মূক ও বধির। বাবা রিকশাচালক ছিলেন, জন্মের পরই তাকে হারিয়েছে পুজা। মা একদিন ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, আর ফিরে আসেননি। তখন থেকেই দিদা অঞ্জলী সিং-এর সঙ্গেই বেড়ে ওঠা। কিন্তু কেমন সেই জীবন?
একচালা ভাঙা টিনের চাল, যেখানে বর্ষার জল চুঁইয়ে পড়ে, শীতে কাঁপতে হয় ছেঁড়া কাঁথার নিচে। দিনে হয়তো একবেলা খাবার জোটে, কখনো আধপেট খেয়ে শুতে হয়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দিদা পরিচারিকার কাজ করে কোনও মতে দিন চালান, মাসে মাত্র হাজার টাকার প্রতিবন্ধী ভাতা আসে, তাতেই চলে সংসার। ভালো খাতা-পেন্সিল দূরের কথা, তিনবেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না। কোনও টিউশন নেই, পড়ানোর কেউ নেই, তবু দিদার কোলে মাথা রেখে নিজের মতো করে বইয়ের পাতায় হারিয়ে যায় পুজা। কেউ বোঝে না, তার মাথায় তখন কী চলছে!
পুজার স্কুল খাদিমপুর বালিকা বিদ্যালয়। সেখানে নেই বিশেষ শিক্ষকের ব্যবস্থা, নেই আলাদা কোনও সহায়তা। তবু নিজের মতো করে সে বোঝার চেষ্টা করেছে, পড়াশোনার প্রতি তার টান দেখে অবাক হন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
প্রধান শিক্ষিকা সুলভা মণ্ডল বলেন, “আমরা ভাবতেও পারিনি ও মাধ্যমিক দেবে! কথা বলতে পারে না, শুনতেও পারে না, কারও সাহায্যও নেই—এমন একটা মেয়ে যে এতটা এগোবে, এটা আমাদের স্কুলের মেয়েদের কাছেও অনুপ্রেরণা!” তবে একথাও মেনে নেন, স্কুলে কোনও স্পেশাল এডুকেটর না থাকায় তারা পুজাকে বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারেন না।
দিদা অঞ্জলী সিং বলেন, জন্ম থেকেই মূক ও বধির পূজা। ছোট বয়সে হৃদপিন্ডের ফুটো ধরা পড়ে। মাঝেমধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যেত। দুর্গাপুর থেকে হার্টের অপারেশন করা হয়েছে। এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়, এর মধ্যে মাধ্যমিক। স্কুলের তরফে পরের বছর মাধ্যমিক দিতে বললেও এই বছর দেওয়ার জেদ তার মাথায় চেপে বসেছে। ইশারাতেই তাকে কথা বোঝাতে হয়। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে নয়, যখন ইচ্ছে করে তখনই সে পড়তে বসে। মাঝেমধ্যেই গভীর ভাবনায় হারিয়ে যায়, কেদে ওঠে। অভাবের তাড়নায় ভালো খাতা, বই বা খাবার কিছুই কিনে দিতে পারেন না তিনি। তবু কিছুতেই পিছিয়ে আসতে চায় না!”
প্রতিবেশী মালতি সিং অবাক, তিনি বলেন “খাওয়া-পরার ঠিক নেই, পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই, তবু কীভাবে মাধ্যমিক দিচ্ছে ও? প্রশাসন কি ওর লড়াইটা দেখবে না?”
পুজার মামী মমতা মন্ডল বলেন, ওকে দেখে আমরা সকলেই অবাক হয়ে যায়। মা-বাবা হারা মেয়ে কথা বলতে পারে না, শুনতে পারে না, প্রাইভেট টিউটর নেই, খাওয়া দাওয়াও সঠিক নেই। তারপরেও ও মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে এটা ভেবেই সবাই অবাক হচ্ছি। বৃদ্ধ দিদা আর কতদিনই বা বাচবে। ওর পাশে প্রশাসনের দাঁড়ানো উচিত।
পুজা কিছু বলতে পারে না, তবু তার চোখের ভাষা স্পষ্ট—সে হার মানতে আসেনি। শিক্ষার আলোয় নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে চায়। কিন্তু সমাজ কি এই আলোর পথ খুলে দেবে? প্রশাসন কি এগিয়ে আসবে?
পুজার লড়াই শুধু তার একার নয়, এটা প্রমাণ যে ইচ্ছাশক্তির সামনে কোনও প্রতিবন্ধকতাই বাধা হতে পারে না। এখন দেখার, এই লড়াইয়ে সে একা থাকে, নাকি সমাজও তার সঙ্গে একসঙ্গে পথ হাঁটে!