পিন্টু কুন্ডু , বালুরঘাট, ২৬সেপ্টেম্বর— চারিদিকের উঁচু লাল প্রাচীরে নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ঘেরা বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে দূর্গা পূজার চিত্র বদলে দিয়েছে পক্সো (Poxo) আইনে জেল খাটা শিল্পীর তৈরি প্রতিমা। একদা কারাগারের চার দেওয়ালে বন্দি থাকা মৃৎশিল্পী রাজু সরকারের হাতে গড়া দুর্গা প্রতিমাই এখন মন খারাপের কথা ভুলিয়ে দেয় আর পাঁচটা বন্দীর। তাঁর তৈরী প্রতিমাই বিগত চার বছর ধরে পূজিত হয়ে আসছে বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। বর্তমানে অবশ্য বিচারে মুক্তি পেয়েছে রাজু সরকার।
বাঙালীর শ্রেষ্ঠ পূজা দুর্গোৎসব। পূজোর দিনগুলিতে কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের উঁচু পাচিলের ভিতরে থাকা আবাসিক বন্দীদের মন খারাপের কথা মাথা রেখে কয়েকবছর আগে একপ্রকার ঘটা করে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু করেছিল তৎকালীন বালুরঘাট সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ। আগে ছোট আকারে পূজা হলেও ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ভিতরে বড় প্রতিমা গড়ে ঘটা করে শুরু হয় দেবী দুর্গতিনাশিনীর পূজা।
ঘটনাচক্রে ২০১৭ সালে বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারেই আবাসিক বন্দী জীবন শুরু হয় দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুরের শেরপুরের বাসিন্দা রাজু সরকারের। এরপর নিজের জীবনের দুর্গতি ঘোচানোর প্রার্থনা করে সংশোধনাগারের ভিতরেই দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু করেন তিনি। শিল্পীর কথায়, তার পরেই নাকি তিনি জামিন পেয়ে যান। এমনকি পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে ওঠা মামলা থেকেও তিনি মুক্তি পান। এখন অবশ্য প্রতিবছর নিয়ম করে শারদ উৎসবের প্রাক্কালে দুর্গা প্রতিমা গড়ার জন্য বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ডাক পড়ে বুনিয়াদপুরের রাজু সরকারের। তবে বর্তমানে সংশোধনাগারের ভিতরে নয়, চলতি বছরে একচালা দুর্গা প্রতিমা গড়ার কাজ ইতিমধ্যেই নিজের বাড়িতেই জোরকদমে শুরু করেছেন রাজু সরকার। এবারে বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের দুর্গা প্রতিমা তৈরী হচ্ছে ডাকের সাজের, দেবী মূর্ত্তিতে থাকছে সাবেকিয়ানার ছাপ।সংশোধনাগারের চার দেওয়ালের মাঝে বন্দীদের আনন্দ দিতে কতৃপক্ষের এমন উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে সাধারণ মানুষের কাছেও।
বর্তমানে বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে আবাসিক বন্দীর সংখ্যা ৮০২ জন। যার মধ্যে মহিলা রয়েছেন ১০১ এবং ৭ জন শিশুও রয়েছে। চলতি বছরের দুর্গা পূজায় সংশোধনাগারের আবাসিক বন্দীদের কথা মাথায় রেখে বিশেষ ব্যবস্থা করেছে বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে সংশোধনাগারের আবাসিক মহিলা বন্দীদের জন্য নতুন শাড়ি এবং আবাসিক মহিলা বন্দীদের সাথে থাকা শিশুদের নতুন জামা-কাপড় প্রদান করার জন্য ইতিমধ্যেই ঠিকাদার সংস্থাকে বরাত দিয়েছে সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে সংশোধনাগারের চার দেওয়ালের ভিতরে শুরু হয়েছে পূজা মন্ডপ গড়ার কাজ। পাশাপাশি দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে সংশোধনাগারের ভবনগুলিকে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। নবমী অথবা দশমীর দিন সংশোধনাগারের ভিতরেই অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক ও বিচিত্রা অনুষ্ঠান। শুধু তাই নয়, পূজোর দিনগুলিতে আবাসিক বন্দীদের জন্য থাকছে বিশেষ মেনু সহযোগে দুবেলা পাত পেরে খাওয়া দাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থাও বলে সংশোধনাগার সুত্রের খবর ।
বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সুপার নবীন কুজুর জানিয়েছেন, চলতি বছরে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা বাজেট রাখা হয়েছে। তিনি জানান দুর্গাপূজার দিনগুলিতে চার দেওয়ালে আবদ্ধ থাকার কারনে সংশোধনাগারের আবাসিক বন্দীদের মন বিষন্ন থাকত। আর সেই কারনে বিগত বছরের ন্যায় চলতি বছরেও বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ভিতরে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে এবং বন্দীদের বিনোদনের জন্য বিচিত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
মৃৎশিল্পী রাজু সরকার জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে পকসো আইনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। সংশোধনাগারে থাকাকালীন মূর্তি গড়ার কথা জানিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষকে। আগে ছোট আকারে হলেও সে বছর থেকে তার হাতে তৈরি প্রতিমা দিয়ে বড় করে জাঁকজমক ভাবে পুজো হয়। দেবীর মাহাত্ম্যেই বিপদ মুক্ত হয়ে আজ বাড়িতে বসেই দুর্গা প্রতিমা তৈরি করছেন।
প্রতিবেশী রেখা মন্ডল জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকে মূর্তি গড়ার কাজ শিখে বাড়িতেই প্রতিমা তৈরি করত রাজু সরকার। তার হাতের তৈরি দেবীপ্রতিমা এখন বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে পূজিত হয়। এতে তারা ভীষণ খুশি এবং আনন্দিত।